সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর রাত যে দীর্ঘ তা আরেকবার প্রমাণিত হলো। রেফারির শেষ বাঁশি না বাজা পর্যন্ত এখানে রিয়ালের পরাজয় ধরে নিতে নেই। প্রতিপক্ষ যত ব্যবধানেই এগিয়ে থাকুক না কেন। তার প্রমাণ বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের বিপক্ষে আজকের ম্যাচ। ২ গোলে পিছিয়ে পড়েও প্রত্যাবর্তনের দারুণ গল্প লিখেছে তারা।
ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের হ্যাটট্রিকে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে ডর্টমুন্ডকে ৫-২ ব্যবধানে হারিয়েছে রিয়াল। এ হারে সবশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের প্রতিশোধ নেওয়া হলো না ডর্টমুন্ডের। বরং শুরুতে এগিয়ে গিয়েও শেষে দেখতে হলো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চে ১৫ বারের চ্যাম্পিয়নদের দোর্দণ্ড দাপট। অথচ প্রতিপক্ষের মাঠে প্রথমার্ধে দাপট দেখিয়েছিল তারাই।
বার্নাব্যুতে ম্যাচের শুরুতেই প্রতি আক্রমণ থেকে গোলের সুযোগ পেয়েছিল ডর্টমুন্ড। তবে ৬ মিনিটে জুলিয়ান ব্র্যান্ডের বাড়ানো বলে রিয়ালের বক্সে থাকা ফরোয়ার্ড সেরহাউ গুইরাসি ঠিকমতো পা লাগাতে না পারলে গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়ার হাতে যায়। এর দুই মিনিট পরেই রিয়াল সুযোগ পায়। ৮ মিনিটে সুযোগটা পেয়েছিলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে। ডর্টমুন্ডের বক্সের বাইরে থেকে লুকা মদরিচ ফ্রি কিক নিলে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের কাছ থেকে প্রতিহত হয়ে ফাঁকা দাঁড়িয়ে থাকা এমবাপ্পে বল পেয়েছিলেন। গোলবার বরাবর শটও নিয়েছিলেন তিনি। তবে তাঁর শট গোলরক্ষক গ্রেগর কোবেল পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তার আগেই প্রতিপক্ষের এক খেলোয়াড়ের শরীরে লেগে প্রতিহত হয়। এরপর দুই দল আক্রমণের চেষ্টা করলেও ফাইনাল থার্ডে গিয়ে ব্যর্থ হয়। তবে ৩০ মিনিটে ঠিকই জাল খুঁজে নেয় জার্মান ক্লাব ডর্টমুন্ড।
বক্সে জটলার মধ্যে থেকে গোলের নায়ক ডোনেল মালেনকে বল বাড়ান গুইরাসি। ডানপ্রান্তে আনমার্ক থাকা মালেন জোরালো শটে কোর্তোয়াকে পরাস্ত করেন। সেই রেশ শেষ হতে না হতেই হলুদবাহিনীদের আনন্দ দ্বিগুণ করেন জেমি বাইনয়ে-গিতেনস। ৩৪ মিনিটে মালেনের কাছ থেকে পাওয়া পাসে শুধু পাটাই লাগান গিতেনস।
দুই গোলে পিছিয়ে পড়ে হতাশ হয়ে পড়েন অ্যান্তোনিও রুডিগার-ভিনিসিয়ুসরা। ৩৬ মিনিটে অবশ্য গোল কমানোর সুযোগ পায় রিয়াল। তবে জুড বেলিংহামের হেড সরাসরি গোলরক্ষক কোবেলের হাতে চলে যায়। এর ২ মিনিট পর ক্রসবার নাটক হয়ে যায়। গোল পেতে পেতে পাওয়া হয় না রিয়ালের। দুই দুইবার বারে লেগে বল ফেরত আসে। সতীর্থের বাড়ানো পাসে রদ্রিগো ভলি করলে গোলবারে লেগে ফেরত আসলে বল পান বেলিংহাম। ইংল্যান্ড মিডফিল্ডার জোরালো শট নিলে আবারো বারে লেগে ফেরত আসে। তৃতীয় চেষ্টায় এমবাপ্পে শট নিলে কর্ণারে মাধ্যমে ডর্টমুন্ডকে রক্ষা করেন কোবেল।
এমন মন্দভাগ্যর পরপরেই আরও একটি গোল হজম করতে বসেছিল রিয়াল। ঘরের মাঠে দলকে রক্ষা করেন কোর্তোয়া। ৩৮ মিনিটে ২৫ গজ দূর থেকে ব্র্যান্ডের নেওয়া জোরালো শট ডান দিকে পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিহত করেন রিয়াল গোলরক্ষক। দুই মিনিট পরেই দ্বিতীয় গোলের নায়ক গিতেনসকেও হতাশ করেন তিনি। ডর্টমুন্ডের মিডফিল্ডারের শট কর্নারের মাধ্যমে প্রতিহত করেন।
প্রথমার্ধ যদি ডর্টমুন্ডের হয় তাহলে দ্বিতীয়ার্ধের রাজত্ব রিয়ালের। সেই ধারায় বিরতির পরেই ব্যবধান কমানোর সুযোগ পেয়েছিলেন এমবাপ্পে। তবে ৫২ মিনিটে বক্সের মধ্যে থেকে নেওয়া তার শট কর্নারের মাধ্যমে সেভ করেন গোলরক্ষক কোবেল। এরপর পরেই ভিনিসিয়ুসের নেওয়া শটও তালুবন্দি করেন ডর্টমুন্ড গোলরক্ষক। কম যান না কোর্তোয়াও। ৫৭ মিনিটে মালেনের নেওয়া ডান পোস্ট ঘেঁষা শটকে ফিস্ট করেন বেলজিয়ামের সাবেক গোলরক্ষক।
কোর্তোয়ার দৃঢ়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রিয়ালকে ম্যাচে ফেরান রুডিগার। ৬০ মিনিটে এমবাপ্পের বাড়ানো ক্রসে হেডে গোল করেন জার্মান ডিফেন্ডার। রুডিগারের গোলের উদযাপন শেষ না হতেই রিয়ালকে সমতায় ফেরান ভিনিসিয়ুস। ৬২ মিনিটে ফ্রান্সের অধিনায়ক এমবাপ্পের পাসকে শুধু গোলবারের পথ দেখিয়ে দেন। শুরুতে অফসাইড ধরা হলেও পরে ভিএআরে গোলটি বৈধতা পায়। এমন প্রত্যাবর্তনের পর একের পর এক আক্রমণ করে ডর্টমুন্ডের রক্ষণভাগকে তটস্থ করে রাখেন এমবাপ্পে-ভিনিসিয়ুসরা। দুই অ্যাসিস্ট করা এমবাপ্পে পরে জালের খোঁজে বক্সের বাইরে থেকে ৭০ মিনিটে শট নিলে তা বিশ্বস্ত হাতে ধরে ফেলেন কোবেল। ৮০ মিনিটে আরেকটি জোরালো শট নিয়েও আশাহত হতে হয় তাঁকে। তাঁর শট হাঁটু গেড়ে প্রতিহত করেন ডর্টমুন্ড গোলরক্ষক।
৮৩ মিনিটে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কায় ছিল রিয়াল। বদলি নামা ম্যাক্সিমিলিয়ানো বেইয়ারের জোরালো শট কোনোরকমে পা দিয়ে ঠেকান থিবো কোর্তোয়া। ডর্টমুন্ড না পারলেও এবার ঠিকই এগিয়ে যায় রিয়াল। বক্সের মধ্যে থেকে দুর্দান্ত এক শটে ৩-২ ব্যবধান এনে দেন লুকাস ভাসকেস। স্প্যানিশ ডিফেন্ডারের গোলে যখন মাঠ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল রিয়াল তাতে যেন মন ভরছিল না ভিনিসিয়ুসের। তাই তো ৮৬ মিনিটে চোখ ধাঁধানো এক গোল করলেন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। সতীর্থ বেলিংহামের কাছ থেকে নিজেদের অর্ধের কাছাকাছি বল পেয়ে ট্রেডমার্ক দৌড়ে ডর্টমুন্ডের দুই খেলোয়াড় এমেরি চান ও নিকোলাস সুলেকে পেছনে ফেলে কাট করে ভেতরে ঢুকে বক্সের বাইরে থেকে বুলেট গতির এক শট নেন ভিনি। যেভাবে শট নিয়েছেন তাতে বল জালে না জড়িয়ে আর পারেনি। গোলের পর উদযাপনও করলেন দেখার মতো। জার্সি খুলে বুনো উল্লাস করলেন তিনি। পরে অবশ্য নিয়ম অনুযায়ী হলুদ কার্ডও দেখতে হয়েছে তাঁকে।
জয় নিশ্চিত হতে ৪-২ ব্যবধান যখন রিয়ালের জন্য যথেষ্ট তখন যেন হ্যাটট্রিক না করে মাঠ ছাড়তে চাননি ভিনিসিয়ুস। যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে সেটাই পূর্ণ করলেন তিনি। ডর্টমুন্ডের বক্সের একটু উপরে বল পেয়ে সুলেকে পরাস্ত করে বক্সে ঢুকে বাঁ পায়ে শট নেন ভিনি। তাঁর শট গোলরক্ষক কোবেলের মাথার উপর দিয়ে জাল খুঁজে নেয়। এতে হ্যাটট্রিক পূর্ণ হয় ২৪ বছর বয়সী ফরোয়ার্ডের। আর রিয়াল পায় ৫-২ ব্যবধানের জয়। ডর্টমুন্ড শুরুতে গোল দিয়ে যেন ভুলই করেছিল!